সতীদাহ প্রথা ও উপমহাদেশের সর্বশেষ সতীদাহের শিকার “রূপ কানওয়ার”

প্রাচীন ভারতের ধর্মীয় চক্র বলয়ে ‘সতীব্রত’ বলে এক প্রথা চালু ছিল, যেখানে নারী তার স্বামীকে কথা দিত, স্বামী যদি আগে গত হয়, তবে সেও সহমরণে যাবে। সতীপ্রথা পালন করা হলে নারীকে বলা হত ‘সতীমাতা’। সতীদাহের কোনো আদেশ হিন্দু ধর্মগ্রন্থে না থাকলেও সেই প্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দের সহমরণের বর্ণনাও পাওয়া গেছে।

রাজা দক্ষের কন্যা দেবি সতী; একইসাথে দেবাদিদেব শিবের স্ত্রী। দক্ষ মেনে নিতে পারেননি তার মেয়ে কোনো শ্মশানবাসী ভবঘুরেকে বিয়ে করবে। একদিন সতীর সামনেই শিবকে কঠোর ভাষায় দক্ষ তিরস্কার করলে স্বামীর অপমান সহ্য না করতে পেরে সতী আত্মহনন করেন। মৃত স্বামীর সাথে চিতায় ওঠার এই প্রথার নামই ‘সতীদাহ’। একে বলা হত ‘সহগমন’, ‘সহমরণ’ বা ‘সতীদাহ’।

জানা যায় – কোনো পরিবার থেকে একজন নারী সতী হওয়া মানে বিরাট সম্মানের বিষয়। একজন নারীর তার স্বামীর প্রতি চূড়ান্ত অধীনতা, সতীত্ব ও ধর্মপরায়ণতার লক্ষণ ছিল এই প্রথা। মনে করা হতো স্বল্পদামী বিধবা নারীর জীবনের বিনিময়ে পরিবারের সম্মান বাড়বে।

কিন্তু দেখা যেত কিশোরী, যুবতী থেকে শুরু করে সব বয়সী বিধবা মেয়েরা পরলোকের প্রতিশ্রুতির চেয়ে আরো কিছুক্ষণের জন্য বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেস্টা করতো। এমন সব নারীরা চিতায় ওঠার আগে বেঁকে বসতো। আসলে খুব কম নারীই ছিল যারা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের দিকে পরলোকের মোহে পড়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে যেত। কেউ কেউ চিৎকার করে কাঁদত, ছেড়ে দিতে বলত। এই আওয়াজ যেন কেউ না শোনে তাই শবযাত্রীরা ঢোল, মাদল, বাঁশির আওয়াজে ভরিয়ে তুলত। অনিচ্ছুক মেয়েদের খাওয়ানো হত আফিম জাতীয় ওষুধ, যেন তারা অজ্ঞান হয়ে পড়ে। কাউকে মাথার পেছন দিকে আঘাত করে অজ্ঞান করে ফেলা হত। লক্ষ্য রাখা হত আঘাত আবার এত জোরে না হয় যাতে মেয়েটা মরেই যায়। রীতি অনুযায়ী জীবিত পোড়াতে হবে। তাহলেই স্ত্রী পরবর্তী জন্মে উঁচু বংশে জন্মাতে পারবে!

পরের জন্মে সম্মান অথবা সমাজে দর্প করে বেড়ানোর আশায় ১৫০০ সাল থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত কয়েক হাজার নারীকে জীবিত পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে স্বামীর চিতায়।

সর্বশেষ ১৯৮৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বরে রাজস্থানের সিকার জেলার দেওরালা গ্রামে স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারা হয় মাত্র ১৮ বছরের রূপ কানওয়ারকে। এই ঘটনায় চরম বিস্ময় ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

রূপ কানোয়ার

রূপকুয়ারবা কানওয়ার ১৯৬৯ খ্রীস্টাব্দে ভারতের রাজস্থানের সিকার জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বিয়ের পর মাত্র আট মাসের মাথায় তাকে স্বামীর চিতায় জীবন্ত দগ্ধ হতে হয়! বাড়ির দরজার দু’পাশে তখনও ফুল-লতা এঁকে লেখা, শুভ বিবাহ। যেনো সদ্য কোনো অনুষ্ঠান হয়ে থাকবে।

১৯৮৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ১৮ বছরের মেয়ে রূপ ‘সতী’ হয়েছিলেন সুমের সিংহের বড় ছেলের চিতায়। জয়পুর থেকে দেড় ঘণ্টার দূরত্বে বাবলা, আকন্দ আর শেয়ালকাঁটার ঝোপে ঘেরা দেওরালা গ্রাম সেই দিন থেকে ‘কুখ্যাত’।

রূপ দ্বাদশ শ্রেণি অবধি পড়েছিলেন। শ্বশুরমশাই নিজে শিক্ষকতা করতেন। মাস্টারজি সুমের সিংহ কানে কম শুনলেও; কেউ সতীর দর্শন করতে এসেছে জানলে, নিয়ে যান সেই ঘরে, যেখান থেকে শেষ বারের মতো বেরিয়ে রূপ ‘সহমরণে’ যেতে বাধ্য হয়েছিলেন! এখনও ঘরের চারপার্শ্ব দেবীত্বে অধিষ্ঠিত। নিত্য পুজো চলে। সতীস্থলেও তাঁর ছবিতে ধুপধুনো, পাশে মানতের নারকেল।

আদালতের নিষেধাজ্ঞায় মন্দিরের কাঠামোটা ওঠেনি তবে; প্রতি একাদশীতে গ্রামের মেয়েরা নিয়ম করে পুজো দেন। সতীস্থল আজ গ্রামের প্রায় অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, বাড়ির পাশে কুয়োর মতোই যেনো স্বাভাবিক।

রূপ কি ‘সতী’ হয়ে এই অমরত্ব চেয়েছিলেন? কেউ বলেন হ্যাঁ, কেউ বলেন না। সুমের সিংহের বলিরেখা শুধু বলে দেয়, তিনি ঠিক দেবযানী বণিকের শ্বশুর নন, বরং ‘দেবী’র ছবি বিশ্বাস। সতীমাতার রূপকল্প শুধু দেওরালা কেন, রাজস্থান জুড়েই, বিশেষত রাজপুত সমাজের কাছে মারাত্মক উন্মাদনার বিষয়।

রাজা রামমোহন রায়, ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং অন্যান্য জ্ঞানী ব্যক্তিদের উদ্যোগ ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক সতীদাহ প্রথা আইনীভাবে বিলুপ্ত হয়। ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর সারা দেশে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় এই নিষ্ঠুর প্রথা। কিন্তু চিতার সেই কালো অন্ধকার কয়েকশো বছর পরেও পিছু ছাড়েনি দেশের কমবয়সী বিধবাদের।

রূপ কানওয়ার ১৮ বছর বয়সে মাল সিং শেখাওয়াতের সাথে মাত্র আট মাস বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। মাল সিং ছিলেন মানসিক রোগী। জানা গেছে আট মাসে রূপ তার স্বামীর সাথে মাত্র ২০ দিন কাটিয়েছেন। ২৪ বছর বয়সে তার স্বামী মারা গিয়েছিলেন। এবং তাদের কোনও সন্তান ছিল না।

কয়েক হাজার মানুষ এই নৃশংস সহমরণ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিল। মৃত্যুর পরে রূপ কনওয়ারকে একটি সতী মাতা – ও একজন খাঁটি সতি মা হিসাবে প্রশংসিত করা হয়েছিল। এই ঘটনাটির জন্য জনসাধারণের মধ্যে দ্রুত হৈ চৈ ছড়িয়ে পড়ে।

কোনো কোনো নিউজ রিপোর্টে কানওয়ারের মৃত্যু স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে বিতর্কিত গল্পরূপে উপস্থাপন করা হয়েছিল! তবে কয়েকটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, উপস্থিত লোকেরা কানওয়ারকে তার মৃত্যুর জন্য বাধ্য করেছিল।

কিছু প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে রূপকে বলা হয়েছিল যে পরিবারের প্রতি সন্মান জানাতে তাকে সতী হতে স্বামীর চিতায় উঠতে হবে! ভয়ে সে পালিয়ে গিয়ে একটি শস্যাগারে লুকিয়েছিল, কিন্তু তাকে খুঁজে এনে মারধর করা হয়েছিল, মাদকাসক্ত করা হয়েছিল। তার শ্বশুরবাড়ির তলোয়ারধারী পুরুষ লোকজন তাকে শেষকৃত্যের দিকে টেনে নিয়ে যায় এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা সাক্ষ্য দেয় যে তিনি ভারী চোট পেয়েছিলেন এবং মুখ থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল!

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছিলেন যে, তাকে তার স্বামীর মৃতদেহের উপরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল এবং তার উপর এমন ভারী কাঠের লগ লাগানো হয়েছিল যে সে যেনো নড়াচড়া করতে না পারে! এরপর অগ্নিসংযোগ করে তাকে জীবন্ত দগ্ধ করা হয়েছিল!

চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকান্ডের ফলে মামলায় ৪৫ জনকে তার হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হলেও পরে খালাস দেওয়া হয়েছিল। দীর্ঘকাল মামলা চলার পর অবশেষে, রাজনীতিবিদসহ ১১ জনকে সতী মহিমান্বিত করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। ৩১ জানুয়ারী ২০০৪, জয়পুরের একটি বিশেষ আদালত এই মামলার ১১ জন আসামির সবাইকে খালাস দিয়েছিলো।

অতঃপর ১৮ বছরের রূপ কানওয়ার ধর্মের বলি হয়ে রূপকথার কাহিনীতে সতী নারী হয়ে রইলেন!

© হারুন-অর-রশীদ।

(Source: Kannabiran, Kalpana (2004) ./ “Voices of Disagreement: Gender and Changed Social Values ​​in Hinduism”, Contemporary Hinduism – Robin Reinhart / “Ethics, Culture and Practice” – ABC-Cleo)

banglaknowledge
banglaknowledge
Articles: 22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *